Explore captivating content and diverse perspectives on our Discover page. Uncover fresh ideas and engage in meaningful conversations
★ দৈনিক পত্রিকা থেকে প্রত্যাক্ষিত একটি গল্প
নীল চোখের ফাঁদে মফিজ মিয়াদের রেমিডেন্স
শহিদুল আলীম
দূর হয়ে যা, দূর হয়ে যা আমার সামনে থেকে। তুই অবিশ্বাসী মহিলা। তোর সব কিছু শেষ হয়েগেছে। যাহ্ যাহ্ দূর হয়ে যা। এখন আর কান্নাকাটি করে কোন লাভ হবে না। ধ্বংস তোর পিছু নিয়েছে।
বাবাজান, আমার ভুল হয়েগেছে, আমাকে মাফ করে দিন। আমার প্রতি দয়া করুন। দয়াকরে আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না। বাবাজান আপনার অসাধ্য কিছু নাই। আমার স্বামীকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনুন।
তখন বলেছিলাম না, এখন কেনো কান্নাজুড়ে দিছোস? তোরা মহিলাদের এই এক স্বভাব মারানি খাওয়ার পর আসোস কান্নাকাটি করতে।
যাহ্ যাহ্ এখন কিছুই করারর নেই আর।
টিনসেট বেঁড়ারঘরের পাকা ফ্লোরে রাজকীয় বিছানা।বেড-তোষকের উপর মখমলের গদিতে হেলান দিয়ে আধ-শুয়া হয়ে সুন্দরি মহিলা ভক্তবৃন্দে বেষ্টিত বাবাজান। নামি-দামি ব্যন্ডের আতরের সুগন্ধে ঘরময় মৌ-মৌ করছে। ত্রিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর বয়সি পাঁচ-ছয়জন বিবাহিত সুন্দরী যুবতি মহিলার দল বাবাজানের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যাঙ্গ টিপে দিয়ে বাবাজানের খাস ফয়েজ হাচিল করে যাচ্ছে। বাকী গোটাবিশেক বিভিন্ন বয়সি মহিলা এক পাশে মাদুরের উপর চুপচাপ দুঃখ ভরাকান্ত অশান্ত দিলের আর্জি পেশের সুযোগের অপেক্ষায় আছে। পাশের রুমে দূর-দূরান্তর থেকে বাবার বরকতপূর্ণ ফয়েজ হাচিলে আসা বিভিন্ন বয়সি বিশ-পঁচিশ জন পুরুষ মাদুরপাতা ফ্লোরে বসে মৃদু স্বরে জিকির করছে। ভবিষ্যৎবানী অগ্রাহ্য করা মহিলাটি বাবাজানের পা'য়ের উপর লুঠিয়ে পড়ে অনবরত হাওমাও করে কান্নাকাটি করেই যাচ্ছে। খাস খাদেম টাইপের সবচেয়ে একজন মহিলা, বিগত ছয়মাস যাবদ প্রবাসী স্বামীর খবর না পাওয়া মহিলাটির পক্ষে বাবাজনকে সুপারিশ করে-
বাবাজান আপনি দয়ার সাগর, বেচারির ভুল হয়ে গেছে। এমন ভুল আর করবে না, তার স্বামিকে তার কাছে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে দিন।
মহিলার কান্নার গতিবেগ আরো বেড়ে গেলো। বাজান গো বাজান স্বামী ছাড়া- টাকা-পয়সা, সোনা-দানা আমার কিছু চাই না। আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দিন। আমার অর্থ-সম্পদ যা কিছু আছে আপনার কদমে হাদিয়া দিয়ে দিবো। সবকিছুই দিয়ে দেবো। আমার গয়নাগাটি টাকাপয়সা প্রয়োজন নাই। শুধু একবার আমার স্বামীকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন। বাবাজানের খাস কামরায় এই হৃদয় বিদারক দৃশ্যপটে পিনপতন নিরবতা নেমে আসে। বাবাজানের হুঙ্কারে উপস্থিত সকলের নিরবতা ভাঙে পূনরায়-
উঠ বলছি উঠ, বেক্কেল মহিলা উঠ।
ঘঠনার আকস্মিকতায় ভয়ে অথবা আদাবের খাতিরে মাথা নিছু করে থাকা ভক্তবৃন্দের দিকে এক নজর চোখ বুলিয়ে নেয় বাবাজান।
এ-বার একটু নরম মোলায়েম স্বরে-
উঠ, দেখি কী করা যায়।
ভরসা পেয়ে মহিলা বাবাজানের পা থেকে মাথা তুলে ভ্যানিটিব্যাগে হাত দেয়। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে পাঁচশত টাকার একটা কচকচে নোটের বান্ডিল বাবাজানের হাতে গুজে দেয় মফিজ মিয়ার বৌ।
এ্যাঁই এ্যাঁই বেটি- একে ভান্ডার খানায় নিয়ে যা।
যা, যা কান্নাকাটি বন্ধ কর এখন, মাওলা ইশারায় সব ঠিক হয়ে যাব। যা ওর সাথে যা, খাওয়া-দাওয়া করে নে। আর শোন আগামি এক সপ্তাহ দরবারের খেদমত করতে হবে। পারবি তো?
জ্বী, বাবাজান যা হুকুম করনে, পালনে কোন ত্রুটি হবে না।
ও হ্যাঁ, দরবারে এক বরণ্য জোড়া প্রানি হাদিয়া দিতে হবে। বুঝে দেখ, পারবি তো?
জ্বি বাবাজান পারবো। ইনশাল্লাহ্
মফিজ মিয়া তার এক নিকট আত্মীয় সেনাবাহিনীর জি ও সি'র মাধ্যমে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ক্যান্টিনে চাল-ডাল সাপ্লাইয়ের টেন্ডার পেয়ে যায়। চার-পাঁচজন স্টাফ ও ম্যানেজার জাকের মিয়ার মাধ্যমে ভালোই চালাচ্ছিলো সাপ্লাই ব্যবসা।
একদিন জাকের মিয়া ক্যান্টিনে চাল-ডাল বুঝিয়ে দেওয়া পর, কৌশলে এক বস্তা চাল সরিয়ে রাখে। চালের বস্তাটি ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের করতে গিয়ে চেকপোস্টে সেনাবাহিনী হাতেনাতে ধরে ফেলে জাকির মিয়াকে। ম্যানেজারের চুরির দায়ে মফিজ মিয়ার সাপ্লাই বাতিল হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত, ক্ষিপ্ত মফিজ মিয়া জাকের মিয়াকে আচ্ছামতো উত্তম-মাধ্যম দিয়ে বাড়ীর উঠোনে বিদ্যুতের খুঁটির সাথে বেঁধে রাখে।দুই দিন গত হওয়ার পরেও জাকের মিয়ার আত্মীয়-স্বজন কেউ ছাড়িয়ে নিতে না আসায়। মফিজ মিয়ার মা'য়ের আদেশে সাদাকাগজে মুচলেখা নিয়ে জাকির মিয়াকে ছেড়ে দেয়। সে-বছরই মফিজ মিয়া বিদেশ পাড়ি দেয়। তিন বছর পর দেশে এসে বিয়ে করে ছয় মাস পর আবার চলে যায়। চোট্টবেলায় পিতৃহারা মফিজ মিয়ার বাড়ীতে বুড়ো মা ছাড়া আর কেউ নেই। বছর ফিরতেই পুত্র-সন্তানের গর্বিত বাবা হয় মফিজ মিয়া। দুবাইতে ভালো বেতনের চাকরি করে, মাসে মাসে বউয়ের একান্টে টাকা পাঠায় মফিজ মিয়া। যুবতি বয়সে স্বামি হারিয়ে অনেক দুঃখ-কষ্টে ছেলেকে বড় করেছে মফিজ মিয়ার মা। এতো দিনে মফিজের মা'র দিকে আল্লাহ মুখ-তুলে তাকিয়েছেন। বউ, নাতি নিয়ে মফিজের মা'র সুখের অন্ত নেই। মফিজ মিয়ার ছেলেকে স্কুলে দিয়েছে। মফিজ মিয়া গতবার দেশে এসে বিশাল মেজবানি করে ছেলের আঁকিকা দিয়ে গেছে। শেষবার যাওয়ার পর কেন জানি বউয়ের সাথে ফোনালাপ তেমন একটা করে না। ফোন করলেও আগের মতো বেশিক্ষণ কথা বলে না, মা, ছেলের খবরাকবর নিয়ে ব্যস্ততার কথা বলে লাইন কেটে দেয়। আগের মতো টাকা-পয়সা, চালানিও পাঠায় না। দুবছর ফেরিয়ে গেলো দেশে আসার খবরও নেই। দেশে আসার কথা তুললে নির্দিষ্ট করে কিছু বলে না, বলে- দেখি, শুধু এ-টুকুই। একবার মফিজ মিয়ার ছেলের খুব জ্বর হলো। দশ দিন গেলো, এতো ঔষধ-পত্রর কিছুতেই জ্বর ভালো হচ্ছে না। পাশের বাড়ীর এক ভাবির পরামর্শে ছেলেকে নিয়ে গেলেন কামেল বাবাজানের কাছে। বাবাজান ছেলেকে কোলে নিয়ে ঝাড়ফুঁক দিয়ে, মফিজের বৌয়ের দিকে কেমন করে যেন অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ভবিষ্যত বাণী করেছিলো- তুই অচিরেই স্বামির সোহাগ থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছিস। তোর স্বামি দুবাইতে এক ফিলিপাইনি মহিলার ফাঁদে আটকা পড়তে যাচ্ছে। এ-বিপদ কাটানো জন্যে দরবারে প্রানি মানত্ করতে পরামর্শও দিয়েছিলো বাবাজান। মফিজ মিয়ার বৌ এসবে কান না দিয়ে, মফিজ মিয়ার উপর অটুট বিশ্বাস রেখেছিলো। দরবার থেকে ফেরার পর ছেলের জ্বর ভালো হয় বটে। কিন্তু গত পাঁচ মাস যাবদ মফিজ মিয়ার আর কোন খবর নেই। মোবাইলও বন্ধ। মফিজ মিয়ার বৌয়ের বুক কেঁপে উঠে, মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে বাবাজানের করা বভিষ্যৎ বাণীর কথা স্বরণ করে। অগত্যা ছেলেকে শাশুড়ির কাছে রেখে বাবাজানের শরানাপন্ন হয় মফিজ মিয়ার বৌ।
বিমানে চড়ার পর মফিজ মিয়ার মনটা ব্যাকুল হয়ে আছে, সাড়েপাঁচ বছর বয়সি রেখে যাওয়া ছেলের জন্যে। আট বছরে পা দেওয়া কলিজার টুকরো ছেলেটার জন্যে। প্রিয়তমা সুন্দরী স্ত্রীর জন্যে। জনম দুঃখি গর্বধারিনি মা'য়ের জন্যে। আবার নিজের উপর খুব রাগও হচ্ছে। নিজেকে নিজে যেন কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছে না। কেন যে সামান্য বিষয় নিয়ে পাকিস্তানি বর্বর গোয়ার পাঠানটির সাথে ঝাগড়া করতে গেলো মফিজ মিয়া। আজ দীর্ঘ ছয়টি মাস বৌ-বাচ্ছা, মা'র সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে জেল খেটে খালি হাতে দেশে ফিরতে হচ্ছে। আল্লাহ জানে আমার সোনা বাবুটি কেমন আছে। প্রিয়তমা বৌ না-জানি মোবাল বন্ধ পেয়ে এ-ছয় মাস কি ভেবে বসে আছে, কি ভাবে কাটিছে সময়। বৃদ্ধা মা ছেলের খবর না পেয়ে না-জানি কেমন আছে ! জেলে ছয় মাস তো বটে, পুরো ভ্রমনেও মফিজ মিয়া এ-রকম হাজারো দুঃচিন্তা ভেতর কাটিয়েছে। দুবাই এয়ার লাইন্সের ফ্লাইটি শাহ আমানত বিমান বন্দরের মাটি ছুঁতেই ছয় মাস জেলের গ্লানি, ছয় ঘন্টা বিমান ভ্রমনের ক্লান্তি উদাও হয়ে যায় মফিজ মিয়ার। ঘন্টা-দুয়েকের মধ্যে প্রান প্রিয় ছেলে, প্রিয়তমা স্ত্রী এবং গর্বধারিনি মায়ের সাথে দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর মিলন হতে যাচ্ছে। এ-সুখে এখন পুলকিত মফিজ মিয়া। বিমান বন্দর থেকে বের হয়েই সি এন জি চালিত অটোতে চড়ে বসে মফিজ মিয়া। বাড়ীর সামনে পা ফেলতেই এলাকার ছেলে-বুড়ো সকলে আগমনে যেন হতবাক। উপস্থিত উৎসুক পাড়াতো ময়মুরুব্বিদের সাথে সালাম বিনিময়ের পর অটো অলার ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির উঠোনে পা রাখ মফিজ মিয়া। ঘরে ডুকতেই মফিজ মিয়ার মা মফিজ মিয়াকে জড়িয়ে ধরে সেকি কান্না! বাপ্ আমার, বুকের ধন, মানিক এতোদিন কোন খবরাখবর না দিয়ে কোথায় ছিলি? কেমন শুকিয়ে গেছিস, কোন বিপদে ঘঠেনি তো?
মা, মা, মা- শান্ত হও, বলছি আগে বসতে তো দাও! মা'য়ের কান্না থামলে মফিজ মিয়া ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে, মাকে বিদেশে ঘটে যাওয়া ঘঠনার সবকিছু খুলে বলে। এতোক্ষণে বৌকে না দেখে মফিজ মিয়া কিছুটা অবাক হয়ে মাকে জিজ্ঞেস করে-
মা, তোমার বৌ'মা কোথায়, দেখছি না যে?
মফিজ মিয়ার মা ছেলেকে বাবাজানের দরবারের কথা খুলে বলে। মায়ের কাছে বিস্তারিত শুনে মফিজ মিয়া পাগলের মতো ছুটে যায় কথিত সেই কামেল পীরবাবার দরবারের উদ্যশ্যে। বাকলিয়া থেকে সাতাশ-আটাশ কিঃ মিঃ দক্ষিণ-পূর্বে বাবাজানের বাড়ী খুঁজতে হয়নি। অটোঅলা একেবারে দরবারের সামনে এসেই অটো থামায়। মফিজ মিয়া অটো থেকে নামতেই চোখ আটকে যায় দরবারের গেইটের উপর- (জাকের ভান্ডার দরবার শরীফ) লিখা বিশাল সাইন বোর্ডে। নির্বাক মফিজ মিয়ার স্মৃতিপটে ভেসে উঠে- মফিজ মিয়া ক্যান্টনমেন্টে চাল-ডালের সাপ্লাই ব্যবসা শুরু করেছে সবেমাত্র একমাস। এরই মধ্যে হিসাব-নিকাশ এবং ক্যান্টিনে ঠিকটাক মতো মাল বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যে একজন স্মার্ট ম্যানেজার দরকার। পরিচিত এক ব্যক্তির মাধ্যমে নীল চোখের সুদর্শন যুবক জাকের মিয়াকে ম্যানেজার হিসাবে মনে ধরে যায় মফিজ মিয়ার। ম্যানেজার নিয়োগ পাওয়ার দুই মাসের মাথায় জাকের মিয়াদের বাড়ীতে কি এক পারিবারিক অনুষ্ঠান ছিলো। জাকের মিয়ার অনুনয়-বিনয়ে টিকতে না পেরে ব্যবসায়িক ব্যস্ততা সত্বেও দাওয়াত কবুল করে মফিজ মিয়া। সে উপলক্ষে ম্যানেজার জাকের মিয়ার বাড়ীতে এসে একবেলা ভালো-মন্দ খেয়েছেও মফিজ মিয়া। এই ক'বছরে রাস্তাঘাট, বাড়ী-ঘর অনেক কিছুর পরিবর্তন হলেও মফিজ মিয়ার স্মৃতি শক্তি এতোটুকুও দুর্বল হয়নি। দরবারের গেইটে ঝুলানো সাইন বোর্ডে কথিত পীর বাবার নুরানি চেহারার ছবিতে মফিজ মিয়ার চোখ আটকে যায়। মফিজ মিয়ার স্মৃতির জানালা আগলা হয়ে চোখের উপর ভেসে উঠে কয়েক বছর পূর্বে চুরির দায়ে বিদ্যুতের খুটির সাথে বাঁধা বেদম মার খাওয়া অনুশোচনাবিহীন সেই বদন। পূনরায় প্রতারিত মফিজ মিয়ার পরাজয় যেনো শাইন বোর্ড থেকে উপভোগ করছে বাবাজানের নুরানি বদন। লোভাতুর নীল চোখের তীর্যক দৃষ্টিতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় মফিজ মিয়া কোথায় জানি বিলীন হয়ে যায়।
দরবারের ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসা খাদেম টাইপের কেউ একজন মফিজ মিয়াকে লক্ষ্য করে-
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বরকাতুহু - জনাব কি দরবারে এসেছেন, তা দাড়িয়ে কেনো? ভিতরে আসুন।
খাদেমের প্রশ্নমিশ্রিত আহ্বানে স্মৃতির অতল গহ্বরের তলদেশে হারিয়ে যাওয়া মফিজ মিয়ার সম্বিৎ ফিরে আসলে বুকের বাম পাশে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে। পুরো দুনিয়া যেন মাথার উপর চক্কর দিয়ে ঘুরছে। খাদেমের প্রশ্ন ও আহ্বানে কোন রকম সাড়া না দিয়ে পূনরায় সে-অটোতেই চেপে বসে।
ড্রাইভার সাহেব, গাড়ী স্ট্রাট দেন।
ভাই সাহেব, দরবারের ভিতর যাবেন না?
নাহ্, চলো ফিরতে হবে, চলো...
বাবাজানের সাথে দেখা করবেন না?
হুম, দেখা হয়ে গেছে।
বলেন কি, ভাই সাহেব! আপনি তো ভিতরে ডুকলেন না, দেখা হলো কি করে?
ড্রাইভার সাহেব আর কোন প্রশ্ন নয়, গাড়ী স্ট্রাট দেন।
চট্টগ্রিমে:
"মিলাদুন্নবী এর নামে চলছে ব্যপক চাদাবাজী
এক ধরনের নেককার বান্দাদের দৌরাত্ব চলছে রবিউল আউয়াল মাস জুড়ে। মাথায় টুপি লাগিয়ে পাড়ার প্রভাবশালীরা মোটা অংকের টাকার রসিদ ধরিয়ে দিচ্ছে বাসায় বাসায়, দোকানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। আসে একসাথে চার/পাচ জন বা তারো বেশী। কোমড়ে পিস্তল লুকিয়ে রাখা ছেলে গুলো যেমন আচরন করে তাদের আচরন তার চেয়ে কয়েক গুন গরম। কেউ কম দিতে চাইলে হবে না। এর কমে নেয়া যাবেনা। কেনো দেয়া যাবেনা তার কৈফিয়ত দিতে হবে সবাইকে। তাদের মন মতো না হলে এরপর আর শান্তিতে থাকা যাবেনা। অমুসলিমদের কাছেও আসে এসব চাদার রসিদ। তাদেরকেও দিতে হবে। কারন তারা এই সমাজে থাকে।
এরা তাদের জন্য একটা ইসলাম তৈরি করেছে। এর বৈধতা দিচ্ছে কিছু ভন্ড পেট পুজারী তথাকথিত হুজুর। সারা মাস জুড়ে বিস্তৃত এলাকায় মাইক লাগিয়ে মানুষেকে বিরক্ত করে তাদের কিছু বানী তারা প্রচার করে, রাসুল (সঃ) নূরের তৈরী, তিনি গায়েব জানেন, তিনি হায়াতে নবী, জিন্দা নবী, তার উছিলায় সব সৃষ্টি করা হয়েছে, আর মিলাদুন্নবী বৈধ। আর এগুলো না মানলে সে কাফের, এগুলো না মানলে নবীর শান মানের উপর আঘাত করা হয়।
এগুলাই কি ইসলাম? নবুয়্যতের শুরু থেকে সাহাবীদের সময় পর্যন্ত বা ইমামদের কাছেও এসব কোন বিষয়ের কি কোন গুরুত্ব ছিল? রাসুল (সঃ) তো শুধু মুসলমানদের জন্য আসেন নি, এসেছেন পুরো মানব জাতীর জন্য, তেমনি কুরআন সব মানুষের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ যারা জ্ঞানের অনুসন্ধান করে। তাহলে কেন রাসুল (সঃ) এবং কুরআন সবার কাছে এতো গুরুত্বপূর্ণ হলো? তিনি নূরের তৈরি বলে? হায়াতে নবী জিন্দা নবী বলে? তিনি গায়েব জানেন তাই? নাকি তাঁর প্রদর্শিত পথ এবং নির্দেশনার জন্য?
অথচ এরা সারা রাত জুড়ে নিজেকে নবীর এমন আশেক দাবী করে, নবীর প্রেমে তারা পাগল হয়ে যায়। কথায় কথায় পেয়ারে নবী। যারা এগুলো বিশ্বাস করবে বা মানবে তারাই শুধু নবীর আশেক। বাকিরা সবাই নবী বিরোধী! আগেই বলেছি এলাকার কোন শ্রেণীর লোক এগুলোর দায়ীত্বে থাকে। এরা যেমন সব কিছু নিজেদের গায়ের জোড়ে করে তেমনি বেহেশতও তাদের গায়ের জোড়ে নিয়ে নিবে। সরকারী খাশ জমি দখল করার মতো বেহেশতও দখল করা যাচ্ছে। কারন তাদের এসব হুজুর সে পথেই নিয়ে যাচ্ছে।
এরা এমন মুসলমান, সামাজিক মিডিয়াতে ভিন্ন মতাবলম্বীদের অশ্লীল ভাষায় গালাগালি থেকে শুরু করে সব ধরণের বাজে কাজ গুলো তারা করে। একজন লোক সে এমনকি নাস্তিক হোক, তাকে গালি দেয়ার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে। গালাগালি করে তুমি নিজেকে কেমন মুসলমান দাবী করো? যে লোকের মুখ থেকে অন্য মানুষ নিরাপদ নয় তাকে তো রসুল (সঃ) মুসলমান হিসেবেই স্বীকার করেননি। এরাই এসব তথাকথিত নেককার বান্দা।
আমার কিছু প্রশ্ন:
ইসলামকে যারা নিজেদের স্বার্থে বিকৃত করে যাচ্ছে তাদের কি আল্লাহ্ কোনদিন ক্ষমা করবেন? কেয়ামতের দিন মুসলমান হিসেবে তাদের কোন পরিচয় থাকবে? রাসুল (সঃ) এর জন্মদিন কবে এটা নিয়ে কোন সাহাবী কখনো প্রশ্ন করেছিলেন (সহী হাদীস থাকলে রেফারেন্স দিবেন)? বা আরবে তখন জন্মদিন নিবন্ধনের বা নোট করার কোন রেওয়াজ ছিল?"
সোর্স: ফেইসবুক পোস্ট।
আগ্রহী বন্ধুদের জন্য
পৃথিবীর প্রথম কবি
কাজী জহিরুল ইসলাম
১৭ নভেম্বর ২০১৭, ১০:২৯ |
শিল্পীর কল্পনায় এনহেদুয়ান্না।
চন্দ্রদেবী সুয়েনের মন্দিরে ধ্যানমগ্ন এক যুবতী, পদ্মাসনে উপবিষ্ট। দুই হাতের করতল সংযুক্ত,
ঈষৎ উত্তোলিত। বুকের দুপাশে নগ্ন স্তনের ওপর দুগাছি কালো চুল।
সুডৌল বাহুযুগল, উন্মুক্ত পিঠ এবং উরুসন্ধির সঙ্গমস্থলে স্ফীত নিতম্ব, যা শ্বেতপাথরের ওপর ছড়ানো একতাল মসৃণ মাংসপিণ্ডের মতো পড়ে আছে। ধু ধু প্রান্তরে মৌন সন্ন্যাসীর মতো দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি ন্যাড়া বৃক্ষ। গোধূলিলগ্ন।
সূর্যাস্তের এক চিলতে লাল আভা এসে পড়েছে দেবী সুয়েনের কপালে শোভিত মুকুটের ওপর।
প্রার্থনামগ্ন আক্কাদিয়ান যুবতীর নগ্ন অবয়ব থেকে এক অলৌকিক আলোর উজ্জ্বল আভা বিকীর্ণ
হচ্ছে। পেছনে সম্রাট সারগনের নেতৃত্বে আক্কাদ সাম্রাজ্যের গণ্যমান্য লোকজন। চন্দ্র দেবীর
কাছে আজ ওদের একটিই প্রার্থনা
—তিনি যেন এই সাম্রাজ্যকে অসুর লুগাল এনের হাত থেকে রক্ষা করেন।
ওপরে বর্ণিত দৃশ্যটি আজ থেকে ৪ হাজার ২৭৪ বছর আগের, অর্থাৎ যিশুর জন্মের ২২৫৮ বছর আগের। এই প্রার্থনাসভার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যে নারী, তাঁর নাম এনহেদুয়ান্না। তখন তিনি ২৭ বছরের পূর্ণ যুবতী। এনহেদুয়ান্না শব্দের
অর্থ অন্তরীক্ষ দেবী। তিনি আক্কাদের সম্রাট সারগন ও তাঁর স্ত্রী রানি তাশলুলতুমের মেয়ে।
অন্য এক মতে, এনহেদুয়ান্না সম্রাট সারগনের (যাঁকে পৃথিবীর সম্রাট বলে অভিবাদন জানানো হতো) মেয়ে নন, তবে রক্তের সম্পর্কিত
আত্মীয়া।
এনহেদুয়ান্না ছিলেন অসম্ভব মেধাবী মানুষ; এক নারী, যিনি প্রার্থনাসংগীত ও কবিতা লিখতে
পারতেন বলে তৎকালীন সমাজ তাঁকে দেবী হিসেবে পূজা করত।
তাঁর পিতা সম্রাট সারগন কন্যা এনহেদুয়ান্নাকে রাজ্যের প্রধান পুরোহিতের সম্মানে ভূষিত করেন।
এই পদটি মর্যাদা পেত রাজ্যের সবচেয়ে সম্মানিত পদ হিসেবে।
সারগনের মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র রামিস সম্রাট হলেও এনহেদুয়ান্না তাঁর স্বপদে বহাল থাকেন। ২২৮৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে জন্মগ্রহণকারী এই নারীই এযাবৎকালের আবিষ্কৃত প্রথম লেখক বা কবি। তিনি ৪২টি স্তবগান রচনা করেন, যা পরবর্তীকালে ৩৭টি প্রস্তরখণ্ড থেকে উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া
তিনি দেবী ইনানার স্তুতি করে আরও বেশ কিছু শ্লোক রচনা করেন।
সুমেরু ভাষার ইনানাই আক্কাদিয়ান ভাষার ইস্তার,
পরবর্তীকালে গ্রিকরা যাঁকে আফ্রোদিতি বলে শনাক্ত করে এবং রোমানরা তাঁকে ডাকে
ভেনাস বলে, তিনি ছিলেন প্রেমের দেবী। দেবী ইনানার স্তুতি স্তাবকে সমৃদ্ধ এনহেদুয়ান্নার কবিতাগুলোই প্রার্থনাসভা-সংগীতের ভিত্তি
নির্মাণ করে। সেই দিক থেকে তিনি ধর্মাবতারের কাজ করেছেন। তাঁর ওপর রাজা সারগনের ছিল পূর্ণ আস্থা।
এনহেদুয়ান্নার মাধ্যমেই তিনি সুমেরু দেব-দেবীদের স্থলে আক্কাদিয়ান দেব-দেবীদের
আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কাজটি করেছিলেন, রাজ্য নিষ্কণ্টক রাখার জন্য এর প্রয়োজন হয়েছিল।
এনহেদুয়ান্নার কাব্যপ্রতিভা তৎকালীন মেসিপটেমিয়ার নারীদের শিক্ষা গ্রহণে এগিয়ে
আসতে অনুপ্রাণিত করে এবং রাজবংশের নারীদের কবিতা লিখতে উৎসাহিত করে। একসময় এটা প্রায় অবধারিতই হয়ে ওঠে যে
রাজকন্যা ও রাজবধূরা অবশ্যই কবিতা লিখতে জানবেন। যদিও তাঁর সমসাময়িককালে আর তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো নারী কবির সন্ধান পাওয়া যায়নি। এতে এটাও প্রতীয়মান হয় যে পার্শি কবি শেলির কথাই ঠিক, কবিতা একটি
ঐশ্বরিক বা স্বর্গীয় ব্যাপার।
তিনি অবশ্য স্বর্গীয় বলতে বুঝিয়েছেন মানুষের স্বর্গীয় অনুভূতির কথা।
এনহেদুয়ান্না সম্পর্কে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ পল ক্রিওয়াসজেক বলেন, ‘তাঁর কম্পোজিশন, যদিও এই আধুনিককালেই কেবল পুনরুদ্ধার করা হলো, সর্বকালের অনুনয়মূলক প্রার্থনার মডেল। ব্যাবিলনীয়দের মাধ্যমে এর প্রভাব হিব্রু বাইবেলে
এবং প্রাচীন গ্রিক প্রার্থনাসংগীতেও এসে পড়েছে।
ইতিহাসের প্রথম কবি এনহেদুয়ান্নার ভীরু শ্লোকগুলোর প্রভাব প্রথম দিকের খ্রিষ্টান
চার্চেও শোনা যেত।’
তখনকার প্রেক্ষাপটে নিয়মতান্ত্রিক প্রার্থনা মানুষের মধ্যে মানবতাবোধ তৈরিতে
সহায়ক ছিল। রাজ্যে ও সমাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। যদিও দেব-দেবীরা
যাঁদের নিয়ন্ত্রণে থাকতেন, অর্থাৎ রাজা বা গোত্র প্রধানগণ ধর্মের নামে জনগণকে প্রতারিতও
করতেন। তা সত্ত্বেও ধর্মই মানুষের অস্থির চিত্তকে নিয়ন্ত্রণে রাখার একমাত্র উপায় ছিল। সেই দিক
থেকে পৃথিবীর প্রথম কবি এনহেদুয়ান্না প্রার্থনা শ্লোক বা দেব-দেবীর স্তুতিবাক্য রচনা করে
একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন মানব সভ্যতার জন্য।
২২৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন পৃথিবীর প্রথম কবি এই মহীয়সী
নারী। তিনি কোনো পুরুষ সঙ্গী গ্রহন করেছিলেন কি না বা কোনো সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন
কি না—এ সম্পর্কে কোনো তথ্য জানা না গেলেও এটা অনুমিত যে রাজ্যের প্রধান পুরোহিত হওয়ার
কারণে হয়তো সংসারের মতো জাগতিক মায়ার বাঁধনে তিনি জড়াননি।
এই লেখায় পৃথিবীর প্রথম কবি
এনহেদুয়ান্নার কিছু শ্লোকের বাংলা অনুবাদ উপস্থাপনের চেষ্টা করছি। অনুবাদগুলো আমি
করেছি ইংরেজি থেকে।
এনহেদুয়ান্না যে পদ্ধতিতে লিখেছিলেন, সেই পদ্ধতিকে বলা হতো কিউনিফর্ম পদ্ধতি। এই
পদ্ধতিতে ৩৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে লিখতে শুরু করে মেসিপটেমিয়ার অধিবাসীরা।
এনহেদুয়ান্নার শ্লোক
১.
আমি তোমার এবং সব সময়
তোমারই থাকব
তোমার হৃদয় আমার জন্যে শীতল
হোক,
তোমার চেতনা, সমবেদনা
আমার প্রতি করুণার্দ্র হোক
তোমার কঠিন শাস্তির স্বাদ
আমি উপলব্ধি করেছি।
(তৃতীয় লাইনের কিছু অংশ
উদ্ধার করা যায়নি। ‘করুণার্দ্র’
শব্দটি যোগ করা হয়েছে চরণকে
অর্থবহ করার জন্য।
এনহেদুয়ান্নার শ্লোক: ১২)
২.
আমার দেবী, আমি ভূমণ্ডলে
তোমার মহানুভবতা ও মহিমা
ঘোষণা করছি
আমি চিরকাল তোমার
মহানুভবতার
গুণগান করে যাব।